তোমার চিঠি পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর লিখতে বসলাম তোমাকে। মনটা, গঙ্গাফড়িং হয়েছে আজ। কেবল উড়ছে আর উড়ছে। খুবই বিষণ্ণ, খুবই ক্লান্ত। কেমন কেমন করছে। তোমার ফুলবনে বেশ কিছুদিন নতুন ফুল পরীর আগমন ঘটেছে। নতুন ফুলপরী, আছে কেমন, কেমন আছো তুমি? খুব জানতে ইচ্ছা করছে বলেই আজ কলম ধরেছি।
বলো না কেমন আছো? কেমন আছে তোমার সুশ্রী, সুরবালা। আমারই, নিশিগন্ধার সৌরভে আমোদিত, আমারই ঘরের বাতাসে আজ ভিন মানুষের নড়াচড়া! আমি নেই ঘরের বাতাসে তোমার, আমার হাসি, আমার কথা নেই শ্রবণে তোমার। নেই আমার চকিত ছোঁয়া, আমার নীরব স্পর্শ। আমি ছাড়া সব আছে সেখানে, বলো, কেমন লাগছে তোমার? আমার জানতে ইচ্ছা করছে। বলো।
প্রিয় সাঁই,
একদিন, এই মহাদেশের সখি নামক নামহীন নগর দ্বারে থেমেছিল তোমার যান। তুমি চেয়েছিলে নগরে ঢোকার পাসপোর্ট-ভিসা। পাসপোর্ট-ভিসা পাওয়ার পর সুন্দরের মোহনায় এক নতুন প্রভাতে প্রথম আলোয় আবিষ্কার করেছিলাম দুজন দুজনকে। কখন একজন একজনের হয়েছিলাম, বুঝতে পারি নি দুজনের কেউই। নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায় হয়েছিলাম স্রষ্টা। মনের ভেতর বেজেছিল সানাই। ফুল বাগানে ফুটেছিল অসংখ্য ফুল - গোলাপ, চামেলি, বেলি, শিউলি, বকুল, কামিনী আরও কতোশত ফুল। আমার খিড়কীতে বসেছিলো এক ছোট্ট দোয়েল। সুরে ভরিয়ে দিয়েছিলো, আমার দিন রাত। আমার উষর জীবনে এসেছিলো মরূদ্যান।
তোমার সুরে সুরে, আমার বুকের ভেতরের ভালোবাসার নদীটি সেই প্রথম খুঁজে পেয়েছিলো উদ্দাম, উদ্বেল এক মোহনা- একদিন যার নাম দিয়েছিলে, 'সূর্য'। মনে কী পড়ে?
প্রিয়ানন্দ,
একদিন কতো নামে ডাকতাম তোমাকে, মনে পড়ছে। মনে পড়ছে প্রতিদিন চিঠি লিখতাম। চিঠি লিখতাম নানা রঙে, নানা ঢঙে। চিঠির মাঝে কতো সাজে তোমাকে সাজাতাম, আজ চোখের জলে মনে পড়ছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, আজ কেন, কী সুখের জন্য তুমি, তোমার প্রিয় প্রতিমা দিলে বিসর্জন। কী দোষে আমি ত্যাজ্য হলাম বলো। আমি তো তোমারই জন্য, তোমারই পথের দিকে চেয়ে, মোমের শিখার মতো উন্মুখ ছিলাম, ছিলাম অধীর আকুতিতে প্রতীক্ষারতা। আমি তো তেমনি আছি, তেমনি আছে আমার মন। তোমারই জন্য এ হৃদয় করেছিলাম তোমার আসন। আমার হৃদয় কেটে পথ করেছিলাম শুধু তোমার জন্য। তবে কেন তুমি আজ ভিন নারী, চন্দ্রাবলীর মানুষ। কেন তুমি আমার কেউ নও, কেন আমি কেউ নই তোমার? আমার ইচ্ছা, অনিচ্ছার কী কোন মূল্য নেই আজ তোমার কাছে? কেন নেই? কেন? কেন?
রাধারঞ্জন
আমি ছিলাম রাইকিশোরী, তুমি শ্যাম-কানাইয়া। প্রিয়তোষ, মনে পড়ে কী আজ সে সব কথা। একদিন যদি দেখা না হতো, তুমি বাসি ফুলের মতো শুকিয়ে ম্লান,যেতে ঝরে। অন্তঃসত্ত্বা হতো তোমার চোখের আকাশ, তোমার হৃদ-জমিনে গজিয়ে উঠত অসংখ্য ক্যাকটাস। আমার দেখা না-পাওয়া পর্যন্ত তুমি প্রতীক্ষা করতে বিরহী যক্ষের মতো, সবুজ ঘাসফড়িঙ হয়ে উড়ে যেতো তোমার মন, আমার সন্ধানে। আমি কোথায়, কোথায় আমি? না পেয়ে তুমি ভেঙে ভেঙে হয়ে যেতে হলুদ দূর্বা। গাছ থেকে তুলে রাখলে জবাফুলের রেণু যেমন শুকিয়ে যায় তেমনি শুকিয়ে যেতে, শুকিয়ে যেতে আকন্দফুলের মতো। শুকিয়ে যেতে তবে গন্ধ থাকতো অটুট ঠিক শুকনো বকুলের মতো।
প্রিয় বংশীধর
কেন বন্ধ হলো তোমার বাঁশি? কেন গেলে চলে? বলেছিলে, চৈতি চাঁদের দুল গড়িয়ে দিবে, দিবে কণ্ঠে আমার তারার মালা গেঁথে। কিন্তু কই দিলে না তো তা ! আরও বলতে, অলক্ত রাগে পা রাঙিয়ে, লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, কপালে গোল লাল টিপে আসবো তোমার কাছে, তুমি বাতাস হয়ে ছুঁয়ে থাকবে আমাকে। আমি তো আজও লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে চরণ রাঙিয়ে, লাল টিপে অপেক্ষা করি তোমার! কিন্তু তুমি আসো না। তুমি বুঝি আর কেউ নও আমার। চিরদিনের মতো কী পর হয়েছো তুমি? পর করে দিয়েছো কী এই আমাকে? অনেক কষ্ট করেই বলছি, জানি আমি, এই আমি আর কেউ নই তোমার, কেউ নই!
ও আমার রাসেশ্বর
ভুলে গিয়েছো তুমি, আমি ভুলি নি। আমি আজও শকুন্তলা, অপেক্ষা করি দুষ্মন্তের। নলের জন্য আমি আজও দময়ন্তি। আমি সীতা, অপেক্ষায় আছি রামের। ফিরে এসো তুমি, এসো ফিরে। ফিরে এসো এই হাওয়ায়, এই আলোয়। আমি রাধা, ১০১টা মোমের শিখা জ্বালিয়ে রেখেছি ঘরে, ছড়িয়ে দিয়েছি তোমার প্রিয় ফুলের সুগন্ধি। তুমি নেই, আসো না তুমি। তবুও রোজ তুমিহীন শূন্য ঘরে বসে থাকি, শুনি তোমার কণ্ঠের গান, আবৃত্তি। ওই গান, আবৃত্তি, ওই কন্ঠস্বরেই ওড়ে আমার ভালোবাসার প্রজাপতি। চক্ষু সজল হয়, হৃদয় আমোদিত হয়, মোহিত হয় জীবন। নিঃসঙ্গতার কুলে ফেলে এই আমাকে, চলে গেছো তুমি। এখন একাকী প্রহর কাটে তোমার স্মৃতির মালা গেঁথে গেঁথে আমার একাকী প্রহর কাটে আমার। আমি বিশ্বাস করি, একদিন তুমি আসবে, আসবে ফিরে এই আমার কাছে, তোমার ফেলে যাওয়া স্মৃতির কাছে। সেদিন মধ্যবর্তী ওইজন কিছুতেই আটকে রাখতে পারবে না তোমাকে। আমার ভালোবাসা সত্য, আমার কষ্ট সত্য। তোমাকে আসতেই হবে।